গাছ একটি আমানত, পরিবারের রক্ষা কবজ। মহানবী সা. নিজ থেকে গাছ রোপণ করেছেন। ধর্মীয় মতে, যদি তুমি জানো আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি গাছের চারা রোপণ কর। কেউ যদি একটি ফল গাছ রোপণ করে এবং সে গাছের ফল পশুপাখি কিংবা মানুষ খায় এমনকি চুরি করেও খায় তবুও সে গাছের মালিক সদকার সওয়াব পায়। কেউ গাছ রোপণ করে মারা গেলে তিনি মৃত্যুর পরও সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পেতে থাকেন এর বিনিময়ে। ধর্মীয় এ অমূল্য বাণীগুলো থেকে বোঝা যায় বৃক্ষরোপণ করা কত বড় মহৎ, কল্যাণ, সওয়াব আর পরিবেশবান্ধব কাজ। নির্মল পরিবেশ রক্ষায় গাছের অবদান অপরিসীম। গাছহীন পরিবেশ মস্তকবিহীন দেহের সমান। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশে শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। পরিবেশ বলতে আমাদের আশপাশের দৃশ্য-অদৃশ্য বস্তু, যেমন- নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল, বায়ু, আলো, শব্দ, এসবের সমন্বিত প্রভাব, যা মানুষের এবং পুরো জীব জগতের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। কথায় আছে, বলবো কিরে ভাই, সবার কাছে বলে যাই, যেই দেশে নাই তরু, সে দেশটা আসলেই মরু। এটি কিন্তু মধু ছন্দ কথা নয় আসল কথা।
গাছ যেভাবে উপকার করে
গাছ গ্রিন হাউস প্রভাবকে প্রশমিত করে, মাটিতে জৈবপদার্থ যোগ করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়, মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে, বহুমুখী খাদ্যের জোগান দেয়, বিশুদ্ধ বাতাস দেয়, দূষিত বাতাস শোষণ করে এর বিষাক্ততা থেকে জীবজগৎকে রক্ষা করে, ওষুধের উপাদান সরবরাহ করে, জ্বালানি, খুঁটি ও গোখাদ্যের জোগান দেয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমিত করে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ায়, চিত্তবিনোদনের উৎস হিসেবে কাজ করে, আসবাবপত্রের জন্য কাঠ সরবরাহ করে, মানুষের আপদকালে বীমা তুল্য কাজ করে, লবণাক্ততা কমায়। তাছাড়াও গাছ অক্সিজেন তৈরি করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যকীয়ভাবে প্রয়োজন; বাতাসের অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ নির্মল বিশুদ্ধ রাখে; মাটির বিষাক্ত পদার্থ ও মাটির অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ শুষে নিয়ে মাটিকে পরিষ্কার রাখে; বাতাস পরিষ্কার রাখে, বাতাসের ধূলিকণা ধরে নির্মল রাখে, তাপ কমায় এবং বায়ু দূষণকারী কার্বন-মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, শোষণ করে; ছায়া দেয়, মায়া দেয় এবং আবহাওয়া ঠা-া রাখে; মাটির ক্ষয় রোধ করে। গাছের শিকড় মাটিকে বেঁধে রাখে এবং গাছের পাতা বাতাসের গতি ও বৃষ্টির গতিকে দমিয়ে রাখে, যা মাটির ক্ষয়রোধে সহায়তা করে; যখন আবাসন গৃহে সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হয়, তখন তার মূল্য অনেক বেড়ে যায়। তাই গাছ আবাসন সম্পদের মূল্য বাড়ায়; মাটিতে পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে; মাটির ভেতরে পানির উচ্চতা বাড়াতে সাহায্য করে; প্রস্বেদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বায়ুম-লে যে পানি ছাড়ে তাতে পরিবেশ শীতল থাকে, মেঘ ও বৃষ্টির সৃষ্টি হয়; আমাদের বিভিন্ন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে। গাছের মতো এত বহুমুখী উপকার আর কেউ কোনোভাবে কখনও করে না।
পরিবেশ রক্ষায় গাছ রোপণ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আমাদের রয়েছে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন মাত্র ১০ ভাগ বনভূমি এবং ৭ ভাগ গ্রামে গঞ্জে রোপিত বা সৃজিত বনভূমি। পর্যাপ্ত বনভূমি না থাকায় আমরা যে সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছি বা সম্মুখীনÑ তা হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে এবং উত্তরাঞ্চল মরুময় হয়ে যাচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অনেক বাড়ছে, বাতাসে জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর ক্লোরোফ্লোরো কার্বন, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুম-লে ওজন স্তরে ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে চলে আসছে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে মেরু অঞ্চল, এন্টার্টিকা মহাদেশের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে মরুময়তা, রাজশাহী বরেন্দ্র অঞ্চলে অনাবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, প্লাবন, দেরিতে বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগামী ২ দশকের মধ্যে বিশ্বের ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বর্তমানে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩০ সাল নাগাদ বেড়ে হবে ৩৪০ বিলিয়ন ডলার। গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
অপরিকল্পিভাবে গাছ কাটার কুফল
ক্রমাগত গাছ কাটার ফলে বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ বিলুপ্ত প্রায়। বাংলার হাজারো প্রজাতির পশুপাখি ও জলজপ্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ৫ হাজার প্রজাতির গাছের মধ্যে ১০০টির বেশি অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত। ৬৩২টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১২টি প্রজাতি এরই মধ্যে বিলুপ্ত, ৩০টি প্রজাতি বিলুপ্তের পথে। ১১০টি পশু প্রজাতির ৪০টির অস্তিত্ব নেই। ৭৮০টি প্রজাতির মাছের মধ্যে ৫৪টির অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। আশঙ্কার কথা ২০২০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ২২ শতাংশ কৃষি জমি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
গাছ আমাদের কী দেয়
একটি গাছ ১ বছরে আমাদের যা দেয় তা হলো ১০টি এয়ারকন্ডিশনার সমপরিমাণ শীততাপ তৈরি করে, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে এবং ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। ১ গ্রাম পানি বাষ্পীভবনে ৫৮০ ক্যালরি সৌরশক্তি ব্যয় হয়। ১টি বড় গাছ দিনে ১০০ গ্যালন পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। ১ হেক্টর সবুজ ভূমি থেকে উদ্ভিদ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ কেজি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ৬৫০ কেজি অক্সিজেন দেয় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকালে। ১টি মাঝারি আকৃতির আমগাছ ৪০ বছরে ১৪ লাখ টাকা মূল্যের অক্সিজেন তৈরি করে। ৫ হেক্টর পরিমাণ বনভূমি থাকলে এলাকার ৩-৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে যায়, ভূমিক্ষয় রোধ এবং বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায়। বৃক্ষরাজি ৮৫-৯০% শব্দ শোষণ করে, শব্দ দূষণ থেকে আমাদের রক্ষা করে।
১ লাখ ইট পোড়াতে ২৫০০ মণ জ্বালানি কাঠ দরকার হয়। আমাদের দেশে প্রতি বছর রান্নার জন্য প্রায় ১০৭ কোটি মণ জ্বালানি কাঠ দরকার হয়। জরিপ বলে ফিনল্যান্ডে ৭৪%, মিয়ানমার ৬৪%, জাপানে ৬৩%, সুইডেনে ৫৫%, কানাডাতে ৪৫%, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪% এবং ভারতে ২০% আর বাংলাদেশে মাত্র ০৯% মতান্তরে ১৭% বনায়ন আছে। অথচ কমপক্ষে ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন। একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক প্রায় ২৫০ গ্রাম সবজি এবং ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে আমরা মাথাপিছু ৪০-৪৫ গ্রাম করে ফল খেতে পারছি। সাধারণত মানুষের মেধা বিকাশের শতকরা ৪০ ভাগ হয়ে থাকে মাতৃগর্ভে এবং অবশিষ্ট ৬০ ভাগ বিকাশ হয়ে থাকে জন্মের ৫ বছরের মধ্যে। ভিটামিন-এ’র অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০-৪০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে অন্ধত্বের শিকার হয়। অথচ পুষ্টি জোগান এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ফলগাছের রয়েছে ব্যাপক অবদান।
ইতিহাসের প্রমাণ করে, গাছ লাগিয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহম্মদ (সা.)। স¤্রাট আকবর তৈরি করেছেন আ¤্রকানন যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আজও বিরাজমান, স¤্রাট শাহজাহান তৈরি করেছেন লাহোরের সালিমারবাগ, ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান এখনও জলন্ত দৃষ্টান্ত। তাছাড়া প্রচলিত হয়ে আছে, কোনো ভালো উদ্যোগ বা কাজ শুরু করলে তার উদ্বোধন করা হয় গাছ লাগিয়ে। এক সময়ের ঘোড়া দৌড় আর মূল্যহীন কাজের আড্ডা ছিল ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নারিকেল গাছের চারা রোপণ করে রেসকোর্স ময়দানের নতুন নাম দেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১৮ ক মোতাবেক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধান করা হয়েছে সুস্পষ্টভাবে।
বৃক্ষ রোপণে চারা-কলম নির্বাচন
গাছ লাগানো কার্যক্রমে শুরুতেই ফলের আদর্শ চারা কলম নির্বাচন করতে হবে। আদর্শ চারার বৈশিষ্ট্য হলো কা- মোটা, খাটো ও মূলের বৃদ্ধি সুষম হতে হবে। তাছাড়া সঠিক বয়সের চারা ও রোগমুক্ত, সতেজ ও সুস্থ সবল চারা সংগ্রহ করতে হবে। বিশ্বস্ত সরকারি কিংবা বেসরকারি নার্সারি থেকে চারা কলম সংগ্রহ করতে হবে।
চারা-কলম রোপণের সময়, কৌশল
বর্ষাকাল সাধারণত আমাদের দেশে চারা-কলম রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। রোপণের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সাধারণত সারা বছরই ফলের চারা-কলম লাগানো যায়। তবে বর্ষার আগে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এবং বর্ষার পরে সাধারণত ভাদ্র-আশ্বিন মাসে চারা রোপণের আদর্শ সময়। যে কোনো গাছের চারা রোপণ করার সর্বোত্তম সময় দিনের শেষভাগে অর্থাৎ পড়ন্ত বিকাল বেলায়। বর্ষার শুরুতে বা প্রথম বৃষ্টির পরপরই চারা লাগানো উচিত হবে না। কারণ প্রথম কয়েক দিন বৃষ্টির পরপরই মাটি থেকে গরম গ্যাসীয় পদার্থ বের হয়, যা চারা গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর এমনকি চারা মারা যায়। চারা-কলম রোপণের জন্য শুরুতেই সঠিক জায়গা নির্বাচন করা দরকার। যেখানে সরাসরি সূর্যের আলো পড়ে, বন্যামুক্ত উঁচু জায়গা যেখানে পানি জমে না সেসব জায়গা নির্বাচন করে জায়গাটি ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রোপণের জন্য গর্ত করতে হবে। ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণের ক্ষেত্রে জাতওয়ারি দূরত্ব ও গর্ত তৈরি করতে ভিন্নতা রয়েছে। গর্ত খনন করার সময় নিচের মাটি একদিকে এবং ওপরের মাটি অন্যদিকে রাখতে হবে। গর্তের ওপরের মাটির সাথে চারা গাছের প্রকার ও জাতভেদে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিংক ও বোরন সার ব্যবহার করতে হবে। তবে অবশ্যই পচা গোবর বা যে কোনো ধরনের কম্পোস্ট সার মাটির সাথে খুব ভালোভাবে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে। সার মেশানোর ১০-১৫ দিন পর চারা রোপণ করতে হয়। মাটি শুকনো হলে পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে নিলে ভালো হবে। গর্তে মাটি ভালোভাবে বসিয়ে মাঝখানে কিছু উঁচু করে নিতে হবে।
রোপণের পর ব্যবস্থাপনা
বিশ্বস্ত স্বনামধন্য ভালো নার্সারি থেকে চারা সংগ্রহের পরপরই ছায়াযুক্ত জায়গায় কয়েক দিন শুয়ে রাখতে হবে। এ অবস্থাকে চারা গাছের হার্ডেনিং বা সহিষ্ণুকরণ-শক্তকরণ বলা হয়। হার্ডেনিংয়ের ফলে চারা গাছের মরে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে যায়। এ অবস্থায় মাঝে মধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে চারার গোড়ায় লাগানো মাটির চাকাটি যেন কোনোভাবেই ভেঙে না যায়। চারা লাগানোর আগে রোগাক্রান্ত, জীর্ণপাতা ও ডালপালা, অতিরিক্ত শেকড় ছেঁটে দিতে হবে। তারপর সতেজ, সবল, রোগমুক্ত, সোজা এবং কম শাখা প্রশাখা বিশিষ্ট চারা অর্থাৎ আদর্শ চারা নির্বাচন করতে হবে। চারায় সংযুক্ত পলিব্যাগ এমনভাবে অপসারণ করতে হবে যাতে চারার গোড়ার মাটির চাকা ভেঙে গুঁড়িগুঁড়ি না হয়ে যায়। চারার গোড়ার চারপাশে কোঁকড়ানো বা আঁকাবাঁকা শিকড় কেটে দিতে হবে। তারপর চারার গোড়ার মাটির চাকাসহ চারাটি গর্তে আস্তে আস্তে আলতো করে অত্যন্ত যত্ন সহকারে বসিয়ে দিতে হবে। বীজতলায় চারাটির যতটুকু অংশ মাটির নিচে ছিল রোপণের সময় ঠিক ততটুকু অংশ মাটির নিচে রাখতে হবে। তারপর চারার চারপাশে ফাঁকা জায়গায় প্রথমে ওপরের উর্বর মাটি এবং পরে নিচের মাটি দিয়ে ভালোভাবে পূরণ করে দিতে হবে। চারপাশের মাটি ভালোভাবে শক্ত করে চেপে ঠেসে দিতে হবে যাতে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো লাগানো চারায় খুঁিট দেয়া। চারা যেন হেলে না পড়ে সেজন্য শক্ত খুঁটি মাটিতে পুঁতে চারার সাথে এমনভাবে বেঁধে দিতে হবে যেন চারা খুঁটির সাথে লেপ্টে লেগে না থাকে। চারা রোপণের পরপরই চারার গোড়ায় ও পাতায় পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। ছাগল, গরু, ভেড়া এসবের হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার জন্য খাঁচা-বেড়া প্রোটেকশন দিতে হবে। নতুনকুঁড়ি বা পাতা বের না হওয়া পর্যন্ত সার প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। ফলদ গাছের ক্ষেত্রে বাড়বাড়তি এবং বয়স আশানুরূপ না হওয়া পর্যন্ত ফুল ফল ভেঙে দিতে হবে।
চারা-কলম লাগানোর পর কোনো কারণে মারা গেলে দ্রুত নতুন চারা-কলম সে গর্তে রোপণ করতে হবে। রোপণকৃত চারা-কলমে পোকা বা রোগে আক্রান্ত হলে সাথে সাথে সমন্বিত বালাই দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। গাছের আকার আকৃতি সুন্দর ও ফলন বাড়ানোর জন্য অঙ্গ ছাঁটাই ও পাতলাকরণ, শাখা ডাল কাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সিকেচার দিয়ে নিয়মিতভাবে রোপণের দুই বছরের মধ্যে পার্শ্বশাখা, চিকন, নরম ও রোগাক্রান্ত শাখা কেটে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে চারা বাড়ার সাথে সাথে প্রতি বছর সারের পরিমাণ ১০ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। গাছে বছরে অন্তত দুইবার সার দিতে হয়। একবার বর্ষার আগে এবং আরেকবার বর্ষার পরে। সুষমসার অবশ্যই জৈব এবং রাসায়নিক সারের সমন্বয়ে দিতে হবে। বড় গাছের গোড়া থেকে কমপক্ষে ০১-০২ মিটার দূর পর্যন্ত গোড়ার কাছাকাছি অংশ যেন অক্ষত থাকে সেভাবে মাটি কোঁদাল দিয়ে ঝুরঝুরি করে সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সার দেয়ার পরপর পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। শীতকালে নিয়মিত সেচ আর বর্ষাকালে নিকাশের ব্যবস্থা নিশ্চিত রাখতে হবে। শীতকালে গাছের গোড়ায় জৈব আবর্জনা দিয়ে মালচিং দিলে ভালো উপকার পাওয়া যায়, গাছের বাড়বাড়তি বেশি হয়, ফলন বাড়ে।
শেষ কথা
সাম্প্রতিক তথ্য মতে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে গড়ে ২১ হেক্টর বনভূমি উজাড় হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ১৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে, যা আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় সমান। এজন্য আমাদের প্রাণের পৃথিবীকে বাঁচাতে টিকাতে হলে প্রত্যেকেই কমপক্ষে একটি ফলদ, একটি বনজ ও একটি ঔষধি গাছ লাগিয়ে দেশে ৫১ কোটি বৃক্ষরোপণ অনায়াসে সম্ভব। আমরা ১৭ কোটি মানুষের সবাই যদি আমাদের জন্মদিনে, প্রিয়জনের বিয়ে বার্ষিকীতে, না ফেরার দেশে চলে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এবং ঈদে, পূজায়, বড়দিনে, বুদ্ধ পূর্ণিমায়, উৎসবে, পার্বণে, নববর্ষে আমরা সবাই বনজ, ফলদ, ভেষজ গাছের অন্তত ৩টি করে চারা-কলম রোপণ করে মানুষের উচ্চতা সমান টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি তাহলে ভাবতে পারি কি অভাবনীয় সফলতা কল্যাণ বয়ে আসবে এ দেশটির। প্রাকতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষ ও বনের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ, মমত্ববোধ বাড়াতে হবে জ্যামিতিক হারে। কেননা বৃক্ষই আমাদের জীবন এবং আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্রষ্টার অপূর্ব নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। প্রাণে যদি বাঁচতে চান, বেশি করে গাছ লাগান। নিয়মিত গাছের যত্ন নিন; গাছকে ভালো রাখুন, গাছও আপনাকে ভালো রাখবে। আপনি আপনারা সবাই ভালো থাকুন গাছের চারা-কলম রোপণ করে টিকিয়ে রেখে। একটাই পৃথিবী সবার দ্বারা সবার জন্য।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*
(কৃতজ্ঞতা : মোহাইমিনুর রশিদ)।
*পরিচালক, কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, ঢাকা